আল্লাহর তাআলার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত হওয়ার এবং চিরস্থায়ী আবাসস্থল জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার জন্য অপরিহর্য বি’ষয় হলো ‘তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়’ অর্জন করা। ‘তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়’ ছাড়া কোনো মানুষই সফলতা অর্জন করতে পারবে না।
তাকওয়া শব্দের অর্থ হলো অতিমাত্রায় সতর্ক থাকা, কোনো কিছু থেকে সম্পূর্ণভাবে বেঁচে থাকা, অধিক মাত্রায় বর্জন করে চলা। তাকওয়া অর্জনের ফলে একজন মানুষ অশ্লীল ও অশালীন কর্ম থেকে বিরত থাকে। মানবিক ও নৈতিক গুণাবলিতে উদ্বুদ্ধ হয়।
অক্সফোর্ড ডিকশনারী অফ ইসলাম অনুসারে, তাকওয়া শব্দটি আল- কুরআনে ” ২৫০ বারের বেশি সময় এসেছে। তাকওয়া মানে সতর্ক ও সচেতন থাকা। বান্দা সতর্ক থাকবে কিছুতেই যেন গুনাহের কাজ সংঘটিত না হয়; আর নেক আমল থেকে কিছুতেই যেন না ছোটে।তাকওয়া অর্জনকারীদের প্রতিদান সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ তাআলা যে সুসংবাদ ঘোষণা করেন; তাহলো-এটা ঐ জান্নাত; যার অধিকারী করব আমার বান্দাদের মধ্যে যারা তাকওয়াবান বা পরহেযগার।’ (সুরা মারিয়াম : আয়াত ৬৩)
নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা পরহেযগার এবং যারা সৎকর্ম করে। (সুরা নহল : আয়াত ১২৮)
হজরত ওমর ফারুক (রা.) উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তাকওয়া কী? উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, আপনি কি কখনও কাঁটা বিছানো পথে হেঁটেছেন? ওমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ। উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, কাঁটা বিছানো পথে আপনি কীভাবে হেঁটেছেন? ওমর (রা.)বলেন,সতর্ক-সচেতনতার সঙ্গে যাতে আমার শরীরে কাঁটা না বিঁধে। উবাই ইবনে কাব (রা.) বললেন, এটাই হচ্ছে তাকওয়া। কাঁটাযুক্ত পথে কাঁটা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ যেভাবে সতর্ক হয়ে চলে, ঠিক সেভাবে আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিষিদ্ধ বিধানগুলো থেকে বেঁচে থাকা এবং আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়ার আশায় নেক আমল করার নামই হলো তাকওয়া। অর্থাৎ রবের ভয়ে পাপ থেকে বিরত থাকা। রবের রহমতের আশায় সওয়াবের কাজ না ছাড়া। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/৪০) তাওয়া অর্জনের উপায় : কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা নিম্ন লিখিত বিষয়গুলো অনুকরণ করলে তাকওয়া অর্জন করার সহজ হবে –
১- কুরআনুল কারীম পাঠ করা: কুরআনে কারীম পাঠ করলে আমরা দেখব, যবানের সংযত ও সঠিক ব্যবহারের সাথে তাকওয়ার একটি গভীর সংযোগ রয়েছে। কুরআনের ভাষ্য হল, যে সঠিক কথা বলে, সবরকম অন্যায় কথা বলা থেকে বিরত থাকে, তার পক্ষে তাকওয়া অর্জন করা সহজ হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন-
হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর সঠিক কথা বল। এতে আল্লাহ তোমাদের আমলসমূহ সংশোধন করবেন, আর তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। আহযাব-(৭০-৭১)
প্রথমে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, পরে এর জন্য একটি পথ বলে দেয়া হয়েছে, সঠিক সত্য ও ন্যায্য কথা বল। এর ফলাফল হল, তোমাদের অন্যান্য আমল সুন্দর ও সঠিক হবে। এবং এভাবে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পাপ মোচন করবেন। (মায়ারিফুল কুরআন: সূরা আহযাব:৭০-৭১
সূরা নিসাতেও তাকওয়ার সাথে “ন্যায়সংগত ও সঠিক কথা” বলার সম্পর্কটি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্য ন্যায় কথা বল। ২. ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করা –
আল্লাহতায়ালার ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, চাই সেটা ফরজ ইবাদত হোক কিংবা নফল।
এরশাদ হচ্ছে, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সুরা বাকারা:২১)
যে সমস্ত ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, তন্মধ্যে একটি ইবাদত হলো ‘সিয়াম’। আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সুরা বাকারা:১৮৩)
৩) কোরআন শিক্ষা করা
আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় আমি এ কোরআনে মানুষের জন্য সব দৃষ্টান্তই বর্ননা করেছি, যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে। বক্রতামুক্ত আরবি কোরআন,যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে। (সুরা জুমার: ২৭-২৮)
৪) আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা-আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাত ও দিবসের বিবর্তন এবং আসমানসমূহ ও জমিনে যা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তাতে বহু নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে। (সুরা ইউনুস- ৬)
৫) ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করা-
আল্লাহ তাআলার ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, চাই সেটা ফরজ ইবাদত হোক কিংবা নফল। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করো। যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের আগে যারা ছিল, তাদেরকে। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো। (সুরা বাকারা: ২১)
৬) রোজা তাকওয়া সৃষ্টি করে
যেসব ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, তন্মধ্যে একটি হলো ‘রোজা’। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো।’ (সুরা বাকারা: ১৮৩)
৭) পরকালের ভয়াবহতা বিষয়ে আয়াত ও হাদিস পাঠ করা পরকাল ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত ও হাদিসগুলো বেশি বেশি অধ্যয়ন করার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, তাদের জন্য তাদের উপর দিকে থাকবে আগুনের আচ্ছাদন আর তাদের নিচের দিকেও থাকবে (আগুনের) আচ্ছাদন; এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভয় দেখান। হে আমার বান্দারা! তোমরা আমাকে ভয় করো। (সুরা জুমার: ১৬)
৮) সুবিচার বা ইনসাফ
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা সুবিচার করো। কেননা তা তাকওয়ার নিকটবর্তী।’ (সুরা মায়িদা: ৮)
৯) নবীপ্রেম
নবীজি (স.)-এর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও তাঁর অনুসরণ মানুষকে উত্তম চরিত্র অবলম্বন করতে বাধ্য করে এবং প্রকৃত মুত্তাকিতে রূপান্তর করে। নবীজির প্রতি শ্রদ্ধার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাসুলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরিশোধিত করেছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার। (সুরা হুজরাত: ৩)
আমরা যদি তাকওয়ার পথে চলতে পারি, তা হলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশাল পুরস্কার দেবেন। মুত্তাকিদের জন্য দুনিয়া-আখেরাতে আনন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন উপহার প্রদান করবেন তিনি। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অর্জন করেছে তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ দুনিয়া এবং আখেরাতে।’ (সুরা ইউনুস: (৬৩-৬৪)
মো: আজিজুল হক
ইসলামী লেখক ও গভেষক।